ইমাম তিরমিজি (রহ.) ইসলামী জ্ঞানবিশ্বের একজন বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ, যিনি সহিহ হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছেন। তার পূর্ণ নাম ছিল আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সাওরাহ ইবনে মুসা আত-তিরমিজি। তিনি হিজরি ২০৯ সালে (খ্রিষ্টীয় ৮২৪ সাল) বর্তমান উজবেকিস্তানের তিরমিজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার নামের সঙ্গে ‘তিরমিজি’ উপাধিটি যুক্ত হয়েছে তার জন্মস্থান তিরমিজের নাম অনুসারে। ইমাম তিরমিজি (রহ.) শৈশবেই জ্ঞানার্জনের প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। অল্প বয়সেই কোরআন মুখস্থ করেন এবং শরিয়ত, তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে দীক্ষা নিতে শুরু করেন। হাদিস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি ইরাক, হিজাজ, খোরাসান ও মাওয়ারাউন নাহরসহ বহু অঞ্চল সফর করেন। তিনি এমন এক যুগে জন্মেছিলেন, যখন হাদিস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রটি এক বৈপ্লবিক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ইমাম বোখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম নাসায়ী প্রমুখ তার সমসাময়িক আলেম ছিলেন, যাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইমাম তিরমিজি ইমাম বোখারির একজন প্রধান ছাত্র ছিলেন এবং তাকে তিনি গুরুতুল্য সম্মান দিতেন। ইমাম বোখারিও তার প্রতিভার গভীর প্রশংসা করেছিলেন। বলা হয়, তিনি যখন কোনো বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন, তখন ইমাম বোখারির শরণাপন্ন হতেন। ইমাম তিরমিজি সমকালীন তিন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের শিষ্যত্ব অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেন—ইমাম বোখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ। ফলে ইমাম তিরমিজির হাদিস সংকলনে এই তিন ইমামের সারনির্যাস সংরক্ষিত হয়েছে।
ইমাম তিরমিজির শ্রেষ্ঠ কীর্তি তার সংকলিত হাদিসগ্রন্থ ‘আল-জামিউত তিরমিজি’, যা সুনানে তিরমিজি নামেও পরিচিত। এটি হাদিসশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ‘সিহাহ সিত্তাহ’ (ছয়টি সহিহ হাদিসগ্রন্থ)-এর অন্যতম। এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য হলো, এতে তিনি হাদিস বর্ণনা করার পাশাপাশি সনদের মান (সহিহ, হাসান, জায়িফ) উল্লেখ করেছেন এবং বিভিন্ন মাজহাব ও ফকিহদের মতামতের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম ‘হাসান’ (সুন্দর, গ্রহণযোগ্য) হাদিস শ্রেণিকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন, যা পরবর্তী হাদিসবিদ্যার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হয়। তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ‘শামায়েলু মুহাম্মদিয়া’ (শামায়েলে তিরমিজি) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ বইয়ে তিনি রাসুল (সা.)-এর চারিত্রিক ও বাহ্যিক সৌন্দর্য, চালচলন, পোশাক, আচার-আচরণ ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন হৃদয়স্পর্শী ভঙ্গিতে। আজও এ গ্রন্থ মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
ইমাম তিরমিজি একজন সাধক, পরহেজগার ও দৃষ্টিশক্তিহীন (জীবনের শেষভাগে) আলেম ছিলেন। বলা হয়, হাদিসচর্চা করতে করতে তিনি অন্ধ হয়ে যান, তবে তাতে তার জ্ঞান সাধনায় বিঘ্ন ঘটেনি। তিনি ছিলেন বিনয়ী, মেধাবী ও গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একজন আলেম। ইমাম তিরমিজি (রহ.) হিজরি ২৭৯ সালে (খ্রিষ্টীয় ৮৯২ সাল) ইন্তেকাল করেন। তার সমাধি উজবেকিস্তানের তিরমিজ অঞ্চলে অবস্থিত, যা আজও মুসলিম জাহানে শ্রদ্ধার কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত। ইমাম তিরমিজি ছিলেন এমন এক আলোকবর্তিকা, যিনি হাদিসশাস্ত্রকে শুধু সংরক্ষণই করেননি, বরং একটি পদ্ধতিগত বিশ্লেষণধর্মী ধারার সূচনা করেছিলেন, যার প্রভাব ও কল্যাণ আজও বিদ্যমান।
মন্তব্য করুন