কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

উপকূলে জীবিকার লড়াই

আবিদা রহমান
উপকূলে জীবিকার লড়াই

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল যেমন—খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ভোলা, কক্সবাজার প্রভৃতি জেলা আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যের অন্যতম নিদর্শন। কিন্তু এ সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা, নদীভাঙন ও জীবিকার টানাপোড়েন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। এ অঞ্চলের মানুষ বছরের অনেকটা সময় কাটান ঝুঁকির মধ্যে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা বন্যা যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। কখনো ‘সিডর’ কখনো ‘আইলা’ আবার কখনো ‘আম্পান’ এসে ভেঙে দেয় তাদের বসতভিটা, মারা যায় অনেক মানুষ, জীবজন্তু, পশুপাখি, মাছ এবং ক্ষতি হয় ফসলের। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে উপকূলের প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, লক্ষাধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় এবং কৃষি ও বন সম্পদের বিশেষ করে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং প্রায় ১৯০ জন নিহত হয়। লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে অধিকাংশ কৃষিজমি অনাবাদি হয়ে পড়ে এবং দেখা দেয় পানি ও খাদ্যসংকট। ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আঘাত হানে। এরপর ২০২০ সালে ‘আম্পান’ নামক ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের প্রায় এক লাখ হেক্টরের বেশি জমির ফসল নষ্ট হয় এবং ৪০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। ২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’য়ের প্রভাবে দেশের ৪১৯টি ইউনিয়নে ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত এবং মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩০ মে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’। মোটকথা ১৯৯১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২০০টির বেশি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ লোক। উপকূলের মানুষের জীবনে প্রকৃতি যেন বন্ধুর চেয়ে শত্রু বেশি।

উপকূলের মানুষের প্রধান জীবিকা হলো মাছ ধরা, চিংড়ি চাষ, কাঁকড়া চাষ, লবণ উৎপাদন ও কৃষিকাজ। অনেক পরিবার খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে, অনেকে আবার সুন্দরবনসহ অন্যান্য এলাকায় মধু আহরণ করে, কেউবা ক্ষুদ্র ব্যবসা করে বাঁচার চেষ্টা চালায়। নারীরাও বসে নেই। তারাও পুরুষের ন্যায় মাছ ধরা, চিংড়ি চাষ ও কৃষিকাজসহ মধু আহরণ করে। অনেক নারী ঘরে বসে হস্তশিল্পের কাজ করেন, কেউ কেউ এনজিও থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গরুর খামার ও হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেছেন। তবে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ মোটেও সহজ নয়। একসময় জমিতে যে পরিমাণ ধান ফলত, এখন সেখানে সেই মাত্রায় ধান হয় না। কেননা লবণাক্ততা এ অঞ্চলের জমির উর্বরতা কেড়ে নিয়েছে। সুপেয় পানির সংকট এখন উপকূলবাসীর অন্যতম বড় সমস্যা। অধিকাংশ জায়গায় নলকূপের পানি পান করার অযোগ্য। অনেকেই কুয়োর পানি বা বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন সারা বছরের জন্য। পানি সংগ্রহ করার জন্য নারী ও শিশুদের দীর্ঘসময় ব্যয় করতে হয়, যা তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ অঞ্চলে শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেলেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি। দুর্যোগ, দূরত্ব, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এর প্রধান কারন। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব উৎপাদন থেকে পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় এখানকার মানুষগুলো অপুষ্টিতে ভোগে, বিশেষ করে চরের অধিবাসীদের অপুষ্টির মাত্রা বেশি থাকে। চরাঞ্চলের অধিবাসীদের কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস সীমাবদ্ধ। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তারা মৌলিক চাহিদা, জীবন ও জীবিকা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শুষ্ক মৌসুমে তারা সুখের মুখ দেখলেও বর্ষায় তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এ মানুষগুলো কখনো হাল ছাড়েন না। বাঁধ নির্মাণ, সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয়, নতুন ধরনের চাষাবাদ সবকিছু শিখে নিচ্ছেন তারা। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন, মেয়েদের কাজ শেখাচ্ছেন, স্বপ্ন দেখছেন একটু ভালো জীবনের।

সরকার উপকূলীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা (যেমন—ত্রাণ ও পুনর্বাসন তহবিল গঠন, বাঁধ নির্মাণ, সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, সবুজ বেষ্টনীয় বনাঞ্চল সৃষ্টি) গ্রহণ করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হলেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে যেমন—সর্বত্র আশ্রয়কেন্দ্রর অভাব, দুর্বল অবকাঠামো ও বাঁধ নির্মাণ, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি এবং পুনর্বাসন ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতা।

উপকূলের মানুষ শুধুই সাহায্যের অপেক্ষায় থাকা কোনো জনতা নয়, তারা প্রত্যেকেই একজন লড়াকু যোদ্ধা। তাদের সংগ্রামকে সম্মান জানানোই হবে দেশের টেকসই উন্নয়নের পথে এক দৃঢ় পদক্ষেপ আর এজন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ, উপকূল উপযোগী অবকাঠামো (যেমন—দুর্যোগ সহনীয় ঘর নির্মাণ, পশুপাখির জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি, আধুনিক ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ) ও প্রযুক্তির (মোবাইল অ্যাপস ও এসএমএসের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় সতর্কবার্তা পাঠানো, স্যাটেলাইট ও রাডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে আগাম নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস প্রেরণ, স্কুল পর্যায়ে ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মে দুর্যোগ শিক্ষা চালু করা) ব্যবহার নিশ্চিত করা। তা ছাড়া জলবায়ু সহনশীল কৃষি, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা এবং নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা—এ তিনটি খাতে জোর দিলে উপকূলের উন্নয়ন বাস্তব হয়ে উঠবে। উপকূলের উন্নয়ন সাধিত হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও উপকূলীয় মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় নেই ডাম্পিং স্টেশন

ঈদে হাট কাঁপাতে আসছে ‘লালু সর্দার’ ও ‘কালিয়া’

ছুটির দিনে ঘুরতে গিয়ে খুন হলেন আব্দুল্লাহ

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যুবকের মৃত্যু, পরিবারের দাবি হত্যা

চরে হঠাৎ জোয়ারের পানি, মৃত অবস্থায় ৩৪ গরু উদ্ধার

মার্কিন মালিকানায় গেল দ্য টেলিগ্রাফ

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ১১ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

আজ কেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া 

ঈদুল আজহা : ট্রেনের ৩ জুনের টিকিট বিক্রি আজ

গাজার উত্তরে এখনো খাবার যায়নি, আরও মৃত্যু ৭৬

১০

২৪ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

২৪ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১২

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রতারণার ফাঁদ, অতঃপর

১৩

‘যারা আজ সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত, তারাই মাকে দূরে রাখতে চায়’

১৪

চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতার পদত্যাগ

১৫

চবি তেপান্তর সাহিত্য সভার নেতৃত্বে আবদুল মোমেন-রিয়াদ উদ্দিন

১৬

বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়কদের দুগ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৪

১৭

সৈকতে পড়ে আছে মৃত ডলফিন, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ

১৮

পতেঙ্গা সৈকতে গোলাগুলি, ঢাকাইয়া আকবরসহ গুলিবিদ্ধ ২

১৯

কারাবন্দি সোহাগের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা

২০
X