শিক্ষা নিয়ে ছেলেখেলা

শিক্ষার্থীদের জন্য নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপানো এবং কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ পুরোনো। চলতি শিক্ষাবর্ষেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী সরকারের বিনামূল্যের ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে প্রায় ৮ কোটিই নিম্নমানের বই পাঠানো হয়। অথচ এবার সরকারের বাড়তি ব্যয় হয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। জোচ্চুরি জালিয়াতির এ ধারাবাহিকতা নিঃসন্দেহে হতাশার, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

বুধবার কালবেলায় এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ছাপানো হয়নি এমন অভিযোগ পাওয়ার পর দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে সরকার। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নেতৃত্বে দুটি পরিদর্শন সংস্থা ও দুটি গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ৩২টি দল ৬৪ জেলায় অভিযান চালায়। এতে উল্লিখিত বিপুলসংখ্যক নিম্নমানের বইয়ের তথ্য মেলে।

অভিযোগ পাওয়ার পর শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার এনসিটিবিকে এসব তথ্য যাচাই করতে টিম গঠনের নির্দেশ দেন। গত এপ্রিল থেকে এ অভিযান শুরু হয়। টিমগুলো সদর জেলা ও উপজেলা শহর ছাড়া মফস্বল এলাকা থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে বই সংগ্রহ করে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে টিমগুলো সারা দেশ থেকে নিম্নমানের বই শনাক্ত করার কাজ শেষ করে এখন প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে। তার আগে মাঠপর্যায় থেকে আনা বইগুলো বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বুয়েট বা বিএসটিআই ল্যাবে পরীক্ষা করানো হয়। অন্যদিকে, বইয়ের মান যাচাই করতে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপার পরের মান যাচাইয়ের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানটিও মাঠপর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করাচ্ছে। একই পদ্ধতিতে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় মাঠপর্যায় থেকে বই সংগ্রহ করে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। এসব টিম দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বইয়ের ছাপার মান ও কভার কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে কি না, কাগজের জিএসএম ও ব্রাইটনেস এবং আর্ট কার্ড ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কি না, তা যাচাই করে। এ ছাড়া বইয়ের মুদ্রণ, ছবি ও বাঁধাই সঠিকভাবে হয়েছে কি না, তাও যাচাই করে। একাধিক টিমের সদস্য ও হাইটেক সার্ভের তথ্যে নিম্নমানের বইয়ের তথ্য উঠে আসে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি বিস্ময়কর দাবি, দেশব্যাপী এ অভিযান ঠেকাতে নাকি খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং এনসিটিবির প্রাক্তন চেয়ারম্যান তৎপরতা শুরু করেন। শিক্ষা উপদেষ্টার টিম গঠনের নির্দেশে চিঠি তৈরি হয় এবং সেই চিঠি বাতিল করে দেওয়া হয়। অবশ্য উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে এক সপ্তাহের মধ্যে টিম গঠিত হয়। আমরা চাই, মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নির্দেশে যে চিঠি বাতিলের অভিযোগ উঠেছে, তা সত্যি কি না—তা খতিতে দেখা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এনসিটিবির নিজস্ব দুটি পরিদর্শন এজেন্সি ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা মাঠে বই ছাপার আগে-পরে একাধিক স্তরে সক্রিয় থাকার পরও এমন নিম্নমানের বই ছাপা হলো কীভাবে এবং তা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাঠানোইবা হলো কীভাবে? এর কারণ হিসেবে তদারকির দায়িত্বে থাকা এজেন্সিগুলোর সঙ্গে প্রিন্টার্সের যোগসাজশ বা সমঝোতা এবং কালো তালিকাভুক্ত ও অদক্ষ প্রিন্টার্সকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অভিযোগ উঠেছে, তাও তদন্তের দাবি রাখে।

আমরা মনে করি, শিক্ষা নিয়ে এ ছেলেখেলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। যে করেই হোক নিম্নমানের বই ছাপিয়ে অর্থ তছরুপের এ ধারাবাহিকতায় ছেদ টানতে হবে। ধরতে হবে সরষের মধ্যকার ভূত। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে যাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ ঊর্ধ্বে, যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে—এটাই প্রত্যাশা।