ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। এ সত্ত্বেও সেনাপ্রধানের বুদ্ধিদীপ্ত তৎপরতার কারণে ওই সময় দেশে তেমন কোনো অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। গত বছর ৫ আগস্ট দুপুরের পর জাতির উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ‘দেশে একটা ক্রান্তিকাল চলছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ করেছিলাম। আমরা সুন্দর আলোচনা করেছি। সেখানে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন দেশের সব কার্যক্রম চলবে।’ ভাঙচুর, হত্যা, সংঘর্ষ ও মারামারি থেকে জনগণকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ‘আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি তাহলে নিঃসন্দেহে সুন্দর একটি পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে পারব। মারামারি ও সংঘাত করে আর কিছু পাব না। তাই দয়া করে ধ্বংসযজ্ঞ, অরাজকতা ও সংঘর্ষ থেকে বিরত হন। সবাই মিলে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হব।’
দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধান যে সততা, দৃঢ়তা, ন্যায়-নিষ্ঠা এবং মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্রমাগত নানা জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ফলে জনমনে নানা শঙ্কা এবং উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে চলতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ সেনা দিবসে রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজ বলে দিলাম, নইলে আপনারা বলবেন, আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের। আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। আই হ্যাড এনাফ লাস্ট সেভেন-এইট মান্থস। আই হ্যাড এনাফ।’
বর্তমান সরকারের মেয়াদ প্রায় দশ মাস অতিক্রান্ত হলেও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ‘রোডম্যাপ’ নিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাটেনি। এমন একটি পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আবারও বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের অধিকার একটি নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। গত বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে তিনি এই অভিমত জানান। এ সময় সেনাপ্রধান আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনোই এমন কোনো কার্যকলাপে যুক্ত হবে না, যা জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর। তিনি সব পর্যায়ের সেনাসদস্যদের নিরপেক্ষ থাকার এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনী দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের নির্দেশ দেন।
আমরা সেনাপ্রধানের শান্তির বার্তাকে স্বাগত জানাই। সেইসঙ্গে তার মতো আমরাও মনে করি, এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’ চলছে। এ অধ্যায়ে সরকারপ্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সংবিধান, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্যের জায়গাগুলো বের করতে চাইছেন। আমাদের প্রত্যাশা, শিগগিরই এসব ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
মন্তব্য করুন