ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতির সমীকরণ। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যকার ঐক্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে ফাটল। ঘন হচ্ছে অস্থিরতার মেঘ। জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। গত বছর ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন এক অভ্যুত্থানের পর ঐক্যবদ্ধভবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন তৈরি হয়, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে সন্দেহাতীতভাবে ঐক্যের বিকল্প নেই। তবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে বিভেদ-অনৈক্য দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা হতাশার।
বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি রাজনীতির মাঠ গরম। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে না পরে, সংস্কার বাস্তবায়ন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মিয়ানমারকে মানবিক করিডোর দেওয়া হবে কি না, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়াসহ নানান ইস্যুতে রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে এ উত্তপ্ত অবস্থা। এসব ইস্যুতে তৎপরতা বেড়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। উত্তাপ ছড়াচ্ছে তাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে। সব মিলিয়ে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির। আর এ অস্থিরতার ভেতরে নতুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার গুঞ্জন।
অবশ্য গতকাল শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করবেন না। তার ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অধ্যাপক ইউনূসের দরকার আছে। এর আগে বৃহস্পতিবার সরকারের আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজের এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য।’
আমরা জানি, চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার রক্তঝরা অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ দেড় দশকের দুঃশাসনের পর এ অভ্যুত্থান জনগণের মধ্যে নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে—গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে সব ধরনের বৈষম্যের বিলোপ, দুর্নীতির মূলোৎপাটনের পাশাপাশি দেশ এগিয়ে যাবে সুশাসনের পথে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে তার প্রথম ভাষণসহ একাধিকবার সে আশাবাদ ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘অধিকার সবার সমান। এ দেশের মানুষ হিসেবে অধিকার আদায়ে বিভক্ত হয়ে নয়, সবাইকে এক হয়ে থাকতে হবে। বাংলাদেশের সবাই এক পরিবার। পার্থক্য করা বা বিভেদ করার সুযোগ নেই।’ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের মেয়াদ এক বছর অতিবাহিত হয়নি, এরই মধ্যে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে বিরাজমান পাল্টাপাল্টি অবস্থান যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, তা অনৈক্যের সুর, যা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলারই অন্তরায়।
আমরা মনে করি, অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যকার এ দূরত্ব দ্রুত অবসান জরুরি। কেননা এ শক্তিগুলোর দূরত্ব অন্য কোনো শক্তির উত্থানের পথ সুগম করতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এত রক্ত, এত প্রাণের বিনিময়ে যে অভ্যুত্থান এবং এর মাধ্যমে যে আকাঙ্ক্ষা বা অভিপ্রায়ের জন্ম হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন হবে সুদূরপরাহত। এমন পরিস্থিতিতে তাই সবচেয়ে যে জায়গাটি বেশি দরকার, তা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য সংহত করা। দেশ গঠন ও জনগণের কল্যাণের প্রশ্নে এক থাকা। আমাদের প্রত্যাশা, রাজনীতিতে উদ্ভূত অস্থিরতার এ মেঘ কাটবে। অচিরেই শুরু হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। এজন্য এই মুহূর্তে দরকার অনৈক্য-বিভেদের সমাপ্তি।
মন্তব্য করুন