বাংলাদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী তরুণ—সে সংখ্যাটি শুধুই দেশের বোঝা নয়, বরং সম্ভাবনারও প্রতীক। অথচ আজ তাদের একটি বড় অংশ উন্নত জীবন, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের আশায় বিদেশের পথে পা বাড়াচ্ছে। ২০২৩ সালে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে গেছেন—২০২২ সালের তুলনায় যা ২৮ শতাংশ বেশি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই গত এক দশকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাম্প্রতিক জরিপে ৫৫ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, তারা স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকতে চান। এ প্রবণতা শুধু ব্যক্তিগত স্বপ্নের প্রতিফলন নয়—বরং দেশের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সুশাসন ও নাগরিক জীবনের বহুমাত্রিক সংকটেরই প্রতিচ্ছবি। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের কথা বলা হলেও বাস্তবতায় এর প্রতিফলন নেই। ২০২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে মোট জিডিপির মাত্র ১.৬৯ শতাংশ, যা বিশ্বের ১০৪টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। জাতিসংঘের সুপারিশ অনুসারে এই হার হওয়া উচিত ৪ থেকে ৬ শতাংশ। বাজেট স্বল্পতায় গবেষণাগার, যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম ও মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে ঘাটতি প্রকট। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই মেধাবীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দেশের উচ্চশিক্ষা থেকে—নতুন স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজছেন বিদেশের মাটিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৩ লাখ বেকারের মধ্যে ৮৭ শতাংশ শিক্ষিত। তরুণদের মধ্যে বিশেষত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ২১ শতাংশ তরুণ কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। শিক্ষা ও শ্রমবাজারের মধ্যে যে ব্যবধান, তার প্রমাণ মিলেছে আইএলওর এক জরিপে, যেখানে ৫৬ শতাংশ নিয়োগকর্তা জানিয়েছেন, তারা প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী পাচ্ছেন না। অন্যদিকে, প্রতি বছর বিশালসংখ্যক তরুণ অপ্রাসঙ্গিক ডিগ্রি নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বায়ু ও পানিদূষণ, যানজট এবং নাগরিক সেবার ঘাটতি—এ সংকট ঢাকাসহ বড় শহরগুলোকে বাসের অনুপযুক্ত করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের শহরগুলো বিশ্বের দূষিত শহরের শীর্ষ তালিকায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, মতপ্রকাশে বাধা, কর্মক্ষেত্রে নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি তরুণদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের জরিপে ৪২ শতাংশ তরুণ বলেছেন, বেকারত্ব তাদের বিদেশমুখিতার প্রধান কারণ। সরকার ‘জাতীয় যুব উদ্যোক্তা নীতি ২০২৫’, ‘উদ্যোক্তা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প’সহ বিভিন্ন কর্মসূচির কথা বলছে। এতে প্রায় ৪০ হাজার কর্মসংস্থান এবং ২.৮ লাখ তরুণের দক্ষতা উন্নয়নের দাবি করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে ঠিকই, তবে ১৮ কোটির দেশে এ উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। শিক্ষা ও সুশাসনে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি না হলে এসব উদ্যোগের প্রভাব স্থায়ী হবে না।
মেধা পাচার রোধে করণীয়—
শিক্ষায় কাঠামোগত রূপান্তর: শিক্ষা খাতে বাজেট জিডিপির ৪-৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে হবে। কারিগরি ও ডিজিটাল শিক্ষা বিস্তারে জোর দিতে হবে।
চাকরির বাজারে স্বচ্ছতা: নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি দূর করতে হবে। ইন্টার্নশিপ ও অ্যাপ্রেন্টিসশিপ প্রোগ্রামের পরিধি বাড়াতে হবে।
নাগরিক জীবনের গুণগত উন্নয়ন: পরিবেশ রক্ষা, গণপরিবহন উন্নয়ন এবং শহরে নিরাপদ ও স্বস্তিকর জীবনযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
মেধা সঞ্চালনের নীতিমালা: বিদেশে অবস্থানরত মেধাবীদের অর্জিত জ্ঞান, প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ দেশের কাজে লাগাতে ট্যাক্স ছাড়, বিনিয়োগ সুযোগ ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
তরুণরা দেশের প্রাণশক্তি। তাদের বিদেশমুখিতা শুধুই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় সংকেত; যা চোখে আঙুল দিয়ে বলে দিচ্ছে কোথায় কোথায় সংস্কার জরুরি। এ সংকট মোকাবিলায় এখন প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত। শিক্ষায় বিপ্লব, কর্মসংস্থানে সুশাসন এবং নাগরিক জীবনে ভরসা ফিরিয়ে আনলেই তরুণরা দেশেই দেখতে পাবেন ভবিষ্যৎ। আর যারা বিদেশে গেছেন, তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেশের উন্নয়নে যুক্ত করে ‘মেধা পাচার’কে ‘মেধা সঞ্চালন’-এ রূপান্তর করা সম্ভব।
মো. শাকিল, শিক্ষার্থী
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ
মন্তব্য করুন