কবিতা বাঁচে কীসের জোরে, কোন প্রাণশক্তিতে? একটি কবিতার বেঁচে থাকার জন্যে কি বিশেষ কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয়, কিংবা আন্তরিক শুশ্রূষার? গাছপালা, পশুপাখি এমনকি সৃষ্টির সেরা মানবকুলেরও বেঁচে থাকার জন্য সেবাযত্ন লাগে, আবার সব পরিচর্যার বাইরে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এবং প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার অসংখ্য দৃষ্টান্তও আছে এই সৃষ্টিজগতে; প্রশ্ন জাগে—কবিতা বাঁচে কী করে? কে বাঁচায় কবিতা, কতদিন বাঁচে কবিতা? এখানে এসে গভীর এবং গূঢ় রহস্যময় আরেক প্রসঙ্গের অভিঘাত টের পাই—একটি কবিতার আয়ুষ্কাল কতদিন বা কত বছর হাতে পারে? জীবজগতের সদস্যদের জীবন-মৃত্যুর সময় পরিধির মতো না হোক, যেহেতু কবিতারও জন্মসময় আছে, তাই সে কবিতার আয়ুষ্কালেরও প্রশ্ন উঠতে পারে। কবিতার বেঁচে থাকা অথবা আয়ু-পরিধি নিয়ে এত সব প্রশ্নের অবতারণা করা হচ্ছে শতবর্ষ পেরিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে উদযাপনের আকাঙ্ক্ষায়।
বিদ্রোহী কবিতা কবে কোথায় কখন রচিত হয়েছে, কোন পত্রিকায় কোন তারিখে প্রকাশিত হয়েছে, কোন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—সেসব নিয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই বললেই চলে, বোধকরি এ অনুসন্ধিৎসারও বিশেষ প্রয়োজন নেই। এ প্রসঙ্গে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের বিবরণই সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য বলেই আমার বিশ্বাস। কাজেই অন্যদিকে নয়, আমরা মনোযোগ দিতে চাই কবিতাটির আয়ুষ্কালের দিকে, ১০০ বছরেরও বেশি বয়স হলো এ কবিতাটির, অথচ পাঠকপ্রিয়তা এবং সাম্প্রতিককালের প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নেও কবিতাটি এতটুকু উজ্জ্বলতা হারায়নি, কবি ও কবিতার মাথা উঁচু করা দর্প একটুও ম্লান হয়নি। অদূর নয়, সুদূর ভবিষ্যতেও তেমন সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সে কারণেই সবিস্ময় প্রশ্ন জাগে—কী আছে এ কবিতাটির মধ্যে, কতটা শৌর্য-বীর্য-সাহসিকতার বারুদে ঠাসা এই কবিতা?
মাত্র ২২ বছর বয়সেই যিনি বাংলা কাব্যের প্রবহমান স্রোতধারাকে নিয়ে গেলেন একেবারে ভিন্নতর খাতে, যার কণ্ঠস্বর স্বতন্ত্র উচ্চতার ও মাত্রার, যার কাব্যরুচি ও মেজাজ প্রচলিত মাপকাঠিতে মূল্যায়ন অসম্ভবপ্রায়, যার কবিতায় অসংখ্য বিদেশি শব্দের অনায়াস ও বহুভঙ্গিম প্রয়োগের মাধ্যমে সৃষ্ট ধ্বনিমাধুর্য ও নতুন ঝঙ্কারে বাঙালি পাঠকমাত্রই চমকিত ও শিহরিত হয়ে ওঠে, সেই কবি নজরুলের ভেতরে কি অমরত্বের কোনো বাসনাই কাজ করেনি কখনো! অনাগতকালের পাঠকের অন্তরে তার কাব্যের অবস্থান ও অধিষ্ঠানের কথা কি সত্যিই কখনো ভাবেননি? ‘আমার কৈফিয়ত’ নামের কবিতায় কেমন অকুণ্ঠচিত্তে নিজেকে তিনি ‘বর্তমানের কবি’ বলে ঘোষণা করেন, এমনকি ভবিষ্যতের নবী হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও যে তার নেই, সে কথাও অকপটে জানিয়ে দেন। ‘বড় কথা বড় ভাব আসে না তো মাথায়’ তাই স্বেচ্ছায় নিজের জগতে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তিনি স্পষ্ট কণ্ঠে আহ্বান জানান—‘অমর কাব্য তোমরা লিখিও বন্ধু, যাহারা আছ সুখে’। তাহলে তার নিজস্ব জগতে কী আছে? আছে মানুষের শোষণ-বঞ্চনার কথা এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা, স্বরাজ-টরাজ নয়, আছে মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের কথা, আছে ক্ষুধাতুর শিশুর আর্তনাদ, আছে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার সুদৃঢ় আহ্বান। তদানীন্তন পরাধীন ভারতবর্ষের এসব অনিয়ম-অনাচার-অবিচারের প্রতিকার করতে না পারার বেদনা থেকে তিনি লেখেন, ‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা’। এ নিয়েই তার কাব্যচর্চা। ‘যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস’ কবি প্রার্থনা করেন তার ‘রক্তলেখায় যেন লেখা হয় তাদের সর্বনাশ’। এমন দ্ব্যর্থহীন স্পষ্ট ঘোষণা শুনে সমকালে সমালোচকদের কেউ কেউ তাকে হুজুগের কবি বলেছেন, স্লোগানসর্বস্ব কবি বলেছেন, তার কবিতার ভবিষ্যৎ-স্থায়িত্ব নিয়ে গভীর আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু এসব মন্তব্য শুনে তিনি নির্বিকার ও নিরুদ্বিগ্নচিত্তে জানিয়ে দেন—‘পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে’। এ নিয়ে তার মোটেই ভ্রুক্ষেপ নেই যেনবা। এমনকি তাকে ‘কবি ও অকবি’
যা-ই বলা হোক, কিছুই যায় আসে না তাতে, তিনি মুখ বুজেই সব সয়ে নেন। এ উচ্চারণে কি কেবলই কবির বিনয় ও ভদ্রতা প্রকাশিত হয়েছে, নাকি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল দৃঢ়তারও প্রকাশ পেয়েছে?
বিস্ময়কর সহজাত কাব্যপ্রতিভা নিয়েই কবি নজরুলের আগমন ঘটে বাংলা কবিতার সজীব শ্যামল আঙ্গিনায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরাধীন ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা কবির সংবেদনকাতর হৃদয়ে এমনই তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করে যে, যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসে সামরিক উর্দি পরিত্যাগ করার পরও নিজের যোদ্ধা-চরিত্র মোটেই বিসর্জন দেননি। বরং খুব সাবলীলভাবে বাংলা কাব্যে সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন সামরিক মেজাজ ও চারিত্র্যের। কে কবে ভাবতে পেরেছিল ‘লেফট-রাইট-লেফট’ কুচকাওয়াজের ধ্বনি দিয়েও বাংলা ভাষায় গান কিংবা কবিতা লেখা সম্ভব হবে! কে জানত বাংলাদেশের রণসংগীত ‘চল চল চল’ আমরা একদা পাব হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছ থেকে! সেই কবি নিজের কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেই ভাবেননি কিছু, সে কথা নির্বিবাদে মান্য করা বড়ই কঠিন। কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব সযত্ন ভাবনা এবং সতর্ক উদ্যোগ হয়তো ছিল না তার, সময়ের দাবিতে এবং শোষিত-নির্যাতিত মানুষের প্রতিবাদের প্রয়োজনে যখন যেমন লেখা জরুরি মনে হয়েছে (স্মর্তব্য—‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’) তিনি তা-ই লিখেছেন। তারপর সময় বদলেছে ঠিকই, কাজী নজরুলের কবিতার আবেদন এবং প্রয়োজনীয়তা একটুও ফুরায়নি। আর সে কারণেই বাঙালির জাতীয় মননের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি বিদ্রোহী কবিতার জন্মের শতবর্ষ পূর্তিতে গ্রন্থ প্রকাশসহ বিশেষ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা জন্মমাত্রই বিপুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত, নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছে। পরবর্তী বছরে রচিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য কবি রাজরোষের শিকার হয়েছেন এবং তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার তাকে জেলও খাটিয়েছে, কিন্তু তার আগেই বিদ্রোহী কবিতা এসে বাঙালি জাতির শিকড় ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছে, বাংলা কাব্যের চরিত্রে এবং গতিমুখে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। সহসা খ্যাতির চূড়া স্পর্শকারী এ কবিতার দুঃসাহসী কবি কাজী নজরুল বাংলা কবিতার রাজ্যে দুর্দান্ত প্রাণশক্তিসম্পন্ন এবং দোর্দণ্ড প্রতাপশালী যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্তও হয়েছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ব্যতিরেকেই গণমানুষের অন্তরে কোনো কবির এমন স্বয়ংক্রিয় অধিষ্ঠান আর কখনো হয়নি। এর উল্টো দিকও আছে। সমকালে নিন্দুকরা বিদ্রোহী কবিতার কুরুচিপূর্ণ প্যারোডি রচনা করেছে, নোংরা পাঁক ঘেঁটে অনুচ্চার্য ও অকহতব্য ভাষায় নিন্দা (খিস্তি-খেউড় বলাই ঠিক) রটিয়েছেন দেদার, অঙ্গুলিমেয় মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও কেউ কেউ সোৎসাহে যোগ দিয়েছেন এ কদর্য কাফেলায়; তাতে বিদ্রোহী কবিতা এবং তার কবির কিছুই হয়নি। বরং শতবর্ষজয়ী এ কবিতা পাঠকসমাজের কাছে এখনো যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক, সাম্প্রতিক এবং আধুনিক বলে বিবেচিত হয়। আরও কত বছর যে এ কবিতাটি বাঙালি পাঠকের বুকের গভীরে বিদ্রোহের মশাল জ্বালিয়ে রাখবে, সেই সম্ভাবনার পরিমাপ করাও অসম্ভবপ্রায় ঘটনা। দীর্ঘ এই একশ বছরে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাঙালির সামাজিক-রাজনৈতিক (ভৌগোলিকও বটে) জীবনে কত না পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে! ভারত ভেঙেছে, বাংলা ভেঙেছে, দু’দুবার স্বাধীনতা এসেছে বাঙালির জীবনে, শেষ পর্যন্ত বাঙালি প্রতিষ্ঠা করেছে নতুন দেশ বাংলাদেশ। প্রতিটি পরিবর্তনেই বিদ্রোহী কবিতা পালন করেছে উদ্দীপনামূলক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবু এখনো সেই বিদ্রোহী কবিতা সমান জনপ্রিয় ও প্রেরণাদায়ী হয়ে আছে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যতদূর বাঙালির বাস আছে ততদূর পর্যন্ত। কিন্তু একটি কবিতার কেন এই ক্রমবিস্তারী জনপ্রিয়তা? কী আছে বিদ্রোহী কবিতার মধ্যে?
আছে সুন্দর ও কল্যাণের কথা, সাম্য ও মানবতার কথা, আছে শোষণ-বঞ্চনা অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের কথা, আছে ভাঙার কথা গড়ার কথা; অসুন্দর-অকল্যাণ-অন্যায়ের প্রতিভূ তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা এবং সর্বোপরি আছে চিরকালীন মানবসত্তার প্রেম ও সৌন্দর্যবোধের কথা। উত্তমপুরুষে বর্ণিত এ কবিতায় কবি নজরুল নিজেকে উন্মোচিত করেছেন স্পর্ধিত ভঙ্গিতে ও অসংকুচিত দৃঢ়তায়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে সময় বদলেছে, সেইসঙ্গে বদলেছে আরও অনেক কিছু। মাথার ওপর শাসক বদলেছে, শাসনপ্রক্রিয়া বদলেছে, রাজনৈতিক-ভৌগোলিক পরিচয় বদলেছে; কিন্তু মানুষের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্যের অবসান হয়নি, শোষণ-লুণ্ঠনের শেষ হয়নি, নজরুল কথিত সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তো হয়েছে সুদূরপরাহত। তাহলে বিদ্রোহী কবিতা পাঠকহৃদয়ে যে স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়, উচ্চকিত করে তোলে চিরন্তন মানব সত্তাকে; তার কী হবে? মানুষ তো যুগপরাম্পরায় সেই কবিতার কাছেই আশ্রয় ও অনুপ্রেরণা খুঁজবে। তাই যদি হয়, তাহলে তো বিদ্রোহী কবিতার আয়ুষ্কাল বেড়েই চলবে। যতদিন ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে’ ধ্বনিত হবে, যতদিন ‘অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে’ শোনা যাবে, ততদিন বিদ্রোহের এ আবাহন ও আবেদন তো শেষ হবে না। ফলে বিদ্রোহী কবিতাও প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না।
বিদ্রোহী কবিতার গভীরে আরও এক প্রাণসম্পদ আছে সদাজাগ্রত। চিরকালীন মানবহৃদয়ে উদ্ভাসিত আনন্দ-বেদনা প্রেম-বিরহের অনুভূতির সহজ ও সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে এ কবিতায়, যা প্রভাতসূর্যের রৌদ্রকিরণের মতোই চির নতুন
চিরউজ্জ্বল। কবি যখন উচ্চারণ করেন—
‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী/ তন্বী নয়নে বহ্নি/ আমি ষোড়শীর হৃদসরোসিজ প্রেম/ উদ্দাম, আমি ধন্যি,/ আমি উদাসীন মন উদাসীর/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন শ্বাস/ হুতাশীর।’
তখন কোনো পাঠকের মনে হতেও পারে এ অংশটুকু বুঝিবা বিদ্রোহী নয়, অন্য কোনো কবিতার অংশ। কিন্তু দেখা গেছে, এ ধরনের হৃদয়ের আর্তিমাখা কোমল পঙক্তিগুলো বিদ্রোহী কবিতায় কঠোরতার পাশে কোমলতার স্নিগ্ধ পেলব পরশ এনে দিয়েছে, উচ্চকণ্ঠ নিনাদের পাশে নূপুরের নিক্কনধ্বনি এনে দিয়েছে, বিদ্রোহের অগ্নিক্ষরণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছায়াময় স্নিগ্ধ লালিত্য। ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’ বলে ঘোষণা দিয়ে যে কবিতার সূচনা হয়, যার উন্নত শিরের কাছে হিমালয়েরও মাথানত হয়, সে-ই যখন গলার স্বর নিচু খাদে নামিয়ে এনে গভীর আন্তরিকতায় উচ্চারণ করেন—‘আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার/ কাতরতা ব্যথা সুনিবিড়/ চিত-চুম্বন-চোর কম্পন থর থর থর/ প্রথম পরশ কুমারীর,/ আমি গোপন পিয়ার চকিত চাহনি/ ছল করে দেখা অনুক্ষণ/ আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা তার/ কাঁকন চুড়ির কনকন।’
তখন যে কোনো পাঠকই বিদ্রোহী কবিতায় বৈচিত্র্যের আস্বাদ লাভ করে এবং বীররসের একটানা প্রবাহ থেকে কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে আসার সুযোগ ও স্বস্তি পায়; পুনর্বার বীররস উপভোগের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। বিদ্রোহী কবিতার এই রসবৈচিত্র্য দীর্ঘ কবিতা হরিৎ আঁচল বিছিয়ে রাখে অনাগতকালের পাঠকের সামনে। তখন অগণিত পাঠকের স্বতঃস্ফূর্ত এবং আন্তরিক পরিচর্যাতেই দীর্ঘ দীর্ঘ কাল বেঁচে থাকে কাজী নজরুলের বিদ্রোহী।
বিদ্রোহী কবিতার অবয়বজুড়ে অসাম্প্রদায়িক উদারনৈতিক মানবতার বাণী উৎকীর্ণ হয়ে আছে, এ কবিতার জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান একটি কারণ নিহিত আছে এইখানে। কাজী নজরুল অসামান্য দক্ষতায় ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম সমাজে দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত মিথগুলো ব্যবহার করেছেন, এমনকি গ্রিক মিথ থেকে অবলীলায় অর্ফিয়াসের বাঁশি এনে শ্যামের হাতের বাঁশরির পাশে নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন। ইস্রাফিলের শিঙার ধ্বনি সম্পর্কেও পাঠক দিব্যি ধারণা পেয়ে যায় এই কবিতার মধ্যেই। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবর্ষের বাঙালির প্রাত্যহিক ও সামাজিক জীবনে বহুল পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত এসব মিথ (তা ধর্মীয় অথবা লৌকিক জীবনে সুপ্রচলিত বলেই) পাঠকহৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে এবং তারা অতি সহজেই বিদ্রোহী কবিতার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে, নৈকট্য অনুভব করে, এ কবিতা হয়ে যায় সবার। তর্ক-বিতর্ক এবং নিন্দা-কুৎসার কণ্টকিত পথ পাড়ি দিয়ে পাঠকপ্রিয়তার সোনালি সিঁড়ি বেয়ে ‘বিদ্রোহী’ শিরোনামের এ কবিতাটিই দুর্বিনীত ভঙ্গিতে নজরুল-রচিত সব কবিতার শিখরে পৌঁছে যায়, কবির অর্জিত পরিচিতিবাচক সব পদবি উপাধি ঠেলে অনতিক্রম্য ভঙ্গিতে সামনে এগিয়ে আসে ‘বিদ্রোহী কবি’ পরিচয়টি। কাজী নজরুল মানেই পাঠকচিত্তে জেগে থাকে বিদ্রোহী কবি নজরুল।
পরিশেষে আমরা স্মরণ করি—বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বটে, তবু তার কবি পরিচয়ই মুখ্য হয়ে জেগে আছে। বহু বিচিত্র কবিতা লিখেছেন তিনি। কত না বিচিত্র সেসব কবিতার শিরোনাম, বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় নির্বাচন, গঠনশৈলী ও উপস্থাপনা-নৈপুণ্য! তবু সবকিছু ছাপিয়ে ‘বিদ্রোহী’ নামাঙ্কিত কবিতাটি স্পর্ধাভরে কবি নজরুলের সব পরিচয়কে ঢেকে দিয়ে ‘বিদ্রোহী কবি’ পরিচিতিকেই যখন মুখ্য করে তোলে, সেইসঙ্গে বিদ্রোহী পরিচয়ই শতসহস্র কণ্ঠে নানাভাবে প্রচারিত হয় এবং পাঠকসমাজও এ পরিচয়কেই বয়ে চলে যুগ যুগ ধরে, তখন ‘বিদ্রোহী’ নামের কবিতাটির সর্বপ্লাবী প্রভাবের কথা মানতেই হয়। এর ভেতরেও কবিতাটির এমন দীর্ঘজীবী হয়ে ওঠার ন্যূনতম সূত্রটির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
মন্তব্য করুন