ইরানের কবি ফাররোখি ও আমাদের কবি নজরুল
ইতিহাসের বুকে কখনো কখনো এমন কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যারা আলাদা ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েও এক অভিন্ন চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠেন। ইরানের ফাররোখি ইয়াজদি ও বাংলার কাজী নজরুল ইসলাম—তেমনই দুই নাম, যারা শব্দের মশাল হাতে অন্যায়ের অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে এসেছিলেন। ইরানের কবি ফাররোখি ও আমাদের কবি নজরুল যেন শব্দের বিপ্লবী দুই যোদ্ধা, যারা শব্দের শানিত তরবারি হাতে একাই যুদ্ধ করে যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যাদের কলম থেকে ঝরে পড়ে বিদ্রোহের আগুন। কাজী নজরুল ইসলাম ও ফাররোখি ইয়াজদির জীবনে কঠোর দমনপীড়নের গল্প আছে।
সংগ্রামের সূচনা
ফাররোখি ইয়াজদির জীবন শুরু হয়েছিল ইয়াজদের এক সাধারণ পরিবারে। জীবিকার জন্য তাকে কখনো টেক্সটাইল কারখানায়, কখনো বেকারিতে কাজ করতে হয়েছিল। কিন্তু তার অন্তরে দাউ দাউ করে জ্বলছিল মুক্তির আগুন। তেহরানে এসে তিনি র্যাডিকাল পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন। অন্যদিকে, নজরুলের শৈশব কেটেছে গ্রামীণ দারিদ্র্যে। কাজ করেছেন মক্তবে, রুটির দোকানে। জীবনের প্রথম থেকেই সংগ্রাম ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সেই দুঃসহ জীবনের মধ্যেই তিনি নিজের ভেতরে গড়ে তুলেছিলেন এক অদম্য বিদ্রোহী সত্তা। সাহিত্য তার কাছে হয়ে উঠেছিল বঞ্চিতের কণ্ঠস্বর।
কবিতা ও পত্রিকা
ফাররোখি তার তুফান পত্রিকা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনৈতিক লেখালেখিতে প্রবেশ করেন। সরকার বারবার তুফান বন্ধ করে দিলেও, তিনি নতুন নামে আবার তা প্রকাশ করেছেন—পেইকার, কিয়াম, সেতারে শরক ইত্যাদি পত্রিকার মাধ্যমে। তার কবিতাও ছিল শাসকদের কড়া সমালোচনা। নজরুলও একই পথ বেছে নেন। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা ছিল তার প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম। তার কবিতা—বিশেষ করে ‘বিদ্রোহী’ বাংলার আকাশে যেন বজ্রধ্বনি তুলেছিল। নজরুলের কলম কখনোই নিছক রোমান্টিকতায় থেমে থাকেনি; বরং তা ছিল যুগপৎ প্রেমের ও বিদ্রোহের ধারালো অস্ত্র।
শাসকের রোষানল
ফাররোখি তার সাহসী লেখার জন্য কারারুদ্ধ হয়েছেন, সেন্সরের শিকার হয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সন্দেহ করা হয়েছে বিদেশি শক্তির সহযোগী হিসেবে। ঠিক একইভাবে নজরুলও ইংরেজ শাসকদের রোষের শিকার হন। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে বসেই তিনি অনশন করেন, যা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। একটি বিখ্যাত গল্প অনুসারে, ১৯০৮ সালের নওরোজের উৎসবে, ফাররোখি উপস্থিত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সামনে এক সাহসী কবিতা আবৃত্তি করেন, যেখানে মোহাম্মদ-আলী শাহের শাসনামলের অন্যায় ও অবিচারের অবসান দাবি করা হয়েছিল। তার শব্দের বাণী এতটাই ক্ষিপ্ত করেছিল উপস্থিত শাসকগোষ্ঠীকে যে ইয়াজদের গভর্নর, জায়ঘাম আল-দৌলা কাশকায়ী, তাকে কারারুদ্ধ করার এবং ঠোঁট সুচ-সুতো দিয়ে সেলাই করার নিষ্ঠুর আদেশ দেন। এ রুদ্ধশ্বাস কাহিনি আজ ফাররোখির জীবনের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন ইরানের আধুনিক যুগে কবিসত্তার দমন ও বাকস্বাধীনতার নির্মম নিপীড়নের চিত্ররূপ। যদিও ইতিহাসবিদদের মতে, এ ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে; তবে বাস্তবতা যা-ই হোক, ফাররোখি ইয়াজদির নাম, সাহসের প্রতীক হয়ে, ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। এমনই এক ঘটনার সাক্ষী আমাদের এই বাংলার মানুষও। ১৯২২ সালের এক বিস্মৃত সকাল। বাংলার আকাশে তখনো ঔপনিবেশিক শাসনের ঘন অন্ধকার। আর ঠিক সেই সময়, এক যুবক কবি, কাজী নজরুল ইসলাম, কলমের ধারালো ফলায় আঘাত করলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অহংকারে। তার কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’, বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে দিল। এতে লেখা ছিল স্বাধীনতার বাণী আর শাসকের শিকল ভাঙার আহ্বান। কিন্তু শাসকরা কবিতার শক্তি বোঝে। শব্দের ভয় তাদের বন্দুকের ভয় থেকেও গভীরতর। তাড়াহুড়ো করে নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হলো। কারাদণ্ড দেওয়া হলো বিদ্রোহী কবিকে যেন কেউ তার কণ্ঠস্বর শুনতে না পায়, যেন তার কবিতা বাতাসে না ছড়ায়। কিন্তু কবিদের কারাগারে বন্দি করা যায় না। জেলের অন্ধকার কক্ষে, লোহার শৃঙ্খলের ভেতর, নজরুল শুরু করলেন অনশন। দিন পেরোয়, রাত পেরোয়। একটানা ৩৯ দিন মুখে জল স্পর্শও করেননি তিনি। তার শরীর ক্ষীণ হয়ে এলো, কিন্তু চেতনার দীপ্তি আরও উজ্জ্বল হলো। পুরো বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তার অনশনের খবর। কবি নিজের জীবনকে শাস্ত্র করে তুলেছেন, যেন এক জ্বলন্ত প্রতীক। শেষ পর্যন্ত দেশের সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, নেতৃবৃন্দ তার জীবন রক্ষার জন্য আবেদন করলেন। তাদের অনুরোধে কবি অনশন ভাঙলেন তবে শাসকের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ থামল না। নজরুল প্রমাণ করে দিলেন কবির কণ্ঠ, যখন সত্যের গান গায় তখন হাজার কারাগারও তাকে স্তব্ধ করতে পারে না।
পরিশেষে বলা যায়, ফাররোখি ইয়াজদি ও কাজী নজরুল ইসলাম হলেন দুই মহাকাব্যিক কণ্ঠস্বর, দুই অনমনীয় যোদ্ধা যারা প্রমাণ করে গেছেন যে কবিতারও যুদ্ধক্ষেত্র আছে, শব্দেরও বিপ্লব আছে। তাদের আদর্শ ও চেতনার সুর এক সুতোয় বাঁধা আর তা হলো সমতা, স্বাধীনতা এবং মানবতার মুক্তি। ফাররোখি ইরানে শ্রেণি-বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন আর নজরুল বাংলার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মুক্তির গান গেয়েছিলেন। তারা সাহিত্যকে শুধু সৌন্দর্যচর্চার সীমানায় আবদ্ধ রাখেননি বরং ইতিহাসের সরাসরি সৈনিক করে তুলেছিলেন, যেখানে কলম ছিল তাদের তলোয়ার, আর শব্দ ছিল তাদের বিপ্লবের ধ্বনি। পথ আলাদা হলেও তাদের লক্ষ্য ছিল এক, মানুষের জন্য, মুক্তির জন্য। নিজেদের জীবন দিয়ে তারা সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, নির্ভীক ও আপসহীন রূপে। তাদের সৃষ্টি আজও প্রমাণ করে দেয় যে সাহিত্যের শক্তি শুধু হৃদয় স্পর্শ করে না, ইতিহাসও গড়ে।
ফাররোখি ইয়াজদি জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালে ইরানের প্রাচীন নগরী ইয়াজদে। তার জীবন, ইতিহাসের পাতায় যতটা নির্মম বাস্তবতায় ঘেরা, ততটাই কিংবদন্তির আবরণে মোড়ানো। জীবনের অন্তিম লগ্নে নিজেই তিনি নিজের গৌরবগাথা রচনা ও পরিবেশনায় এক ধরনের আনন্দ লাভ করতেন।
মির্জা মোহাম্মদ, যিনি ‘ফাররোখি’ ছদ্মনামে এবং ‘তাজ আল-শোয়ারা’ উপাধিতে পরিচিত, ছিলেন একজন কবি, সংবাদপত্র সম্পাদক, স্বাধীনতাকামী ও রাজনৈতিক কর্মী। তিনি ইয়াজদের এক পরিশ্রমী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি কৃষকদের দুঃখ-কষ্ট ও নিপীড়নের সঙ্গে পরিচিত হন এবং এ অভিজ্ঞতা তার মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেয়:
‘আমিই সেই রক্তাক্ত, ভগ্ন হৃদয়ের মানুষ
যার কাজ কেবলই রক্ত গেলা।
আমার একমাত্র গর্ব
আমি এক কৃষকের সন্তান’।
তার কৃষক সন্তান হওয়া আজকের ভাষায় এক শিশুশ্রমিক হওয়ার মতো ছিল। তিনি শিশুকালেই পাদুকার কাজ এবং রুটির দোকানে কাজ শুরু করেন। ইয়াজদের গাজারগাহ মহল্লায় যখন তিনি অভিজাতদের জন্য রুটি নিয়ে যেতেন, তখন তিনি ইংরেজ মিশনারিদের পরিচালিত একটি হাসপাতালেও রুটি পৌঁছে দিতেন। এর সুবাদে তিনি হাসপাতালের পাশে থাকা ইংরেজ মিশনারিদের স্কুলে পড়ার সুযোগ পান। কিছুদিন তিনি মক্তবখানায়ও পড়েছিলেন এবং সেখানে ফারসি ও আরবির প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।
শৈশব থেকেই তার কবিতার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল এবং তরুণ বয়সে তিনি ইয়াজদের বিখ্যাত কবি শওকত ইয়াজদির কাছে অলংকারশাস্ত্র ও কাব্যরীতির শিক্ষা নেন। জীবনের দুঃখ-কষ্ট দেখে এবং আশপাশের মানুষের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে তার বিপ্লবী মনের সৃষ্টি। নিজের কবিতার মাধ্যমে তিনি অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন এবং স্বৈরতন্ত্র ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। সাদির কবিতা তার শিল্পচেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি মাসউদ সাদ সালমানের কবিতা থেকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। ১৫ বা ১৬ বছর বয়সে তার ইমান ও ধর্মীয় অঙ্গীকার তাকে মিশনারি স্কুলের কর্তৃপক্ষের আচরণ সহ্য করতে দেয়নি। তিনি দেখেছিলেন, স্কুলের শিক্ষকরা, যারা অগ্নিপূজক বা খ্রিষ্টান ছিলেন, মুসলিম ছাত্রদের ইমান নষ্ট করে দিচ্ছিলেন। এ অবস্থা দেখে তিনি প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এবং একটি কবিতা রচনা করেন, যেখানে তিনি ইয়াজদের জনগণকে নিজেদের সন্তানদের এদের হাতে তুলে দিয়ে ধর্ম ও সংস্কৃতির সর্বনাশ ডেকে আনায় ভর্ৎসনা করেন।
যখন হলো মাথানত, স্বাধীনতার চরণে,
জীবন ত্যাগও হলো তখন, শান্ত হৃদয় ভরে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফাররোখি ইরাকের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু সেখানে তার স্বাধীনতাকামী অতীতের জন্য ইংরেজদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন এবং বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে ইরানে ফিরে আসেন। যাত্রাপথে তিনি রাশিয়ান সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হলেও সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। এ সময় তিনি রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন এবং তার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বিকশিত হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই, জনগণের অধিকারের পক্ষে অবস্থান এবং স্বাধীনতা—এসবই ফাররোখির সাহিত্যিক জীবনের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
মন্তব্য করুন