সময়ের গভীর আত্মসংকট যখন দিকহারা করে তোলে নাগরিক সত্তাকে, তখন শিল্পই ডাকে আত্মার ভেতরকার উড়ান। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হলো সেই আত্মানুসন্ধানের নাট্যরূপ ‘পাখিদের বিধানসভা’।
ধ্রুপদি সুফি সাহিত্যের গূঢ় তাৎপর্যকে সমকালীন বাস্তবতায় নির্মাণ মঞ্চে উঠে এসেছে এক ব্যতিক্রমী নাট্যযাত্রা, যা একাধারে আত্মিক অনুসন্ধান, রাজনৈতিক প্রতীকায়ন এবং ব্যক্তিগত রূপান্তরের উপাখ্যান। বিশৃঙ্খল নাগরিক জীবনের শূন্যতা, রাষ্ট্রব্যবস্থার অকার্যকারিতা, তরুণ সমাজের গভীর উদ্বেগ—সব মিলিয়ে একটি সময়-সংবেদী ভাষ্য হয়ে উঠেছে এ প্রযোজনা।
সুফি সাহিত্যিক ফরিদউদ্দিন আত্তারের ‘কনফারেন্স অব দ্য বার্ডস’ অবলম্বনে রচিত হলেও ‘পাখিদের বিধানসভা’ বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র বাস্তবতার অন্তরঙ্গ পাঠ। এখানে হুদহুদ পাখির ডাকে পাখিরা যেমন বেরিয়ে পড়ে পরম সত্যের সন্ধানে, তেমনি দর্শককেও আমন্ত্রণ জানানো হয় তার নিজস্ব আত্মার দিকে ফিরে তাকাতে—জানতে, বুঝতে এবং উপলব্ধির পথে হাঁটতে।
ড. শাহমান মৈশানের রচনায় এবং ড. আহমেদুল কবিরের নির্দেশনায় নাটকটি হয়ে উঠেছে আত্মজিজ্ঞাসার এক প্রজ্ঞাময় প্রবন্ধ—যেখানে প্রতিটি দৃশ্য একেকটি ধ্যান, প্রতিটি সংলাপ একেকটি অন্তদর্শনের কণ্ঠস্বর।
নাটকটি মোট পাঁচটি পর্বে বিন্যস্ত। প্রথম পর্বে তুলে ধরা হয়েছে এক ব্যর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে নাগরিকদের নৈরাজ্য, বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের চক্রাকারে আবর্তিত এক ধরনের অস্তিত্ব সংকট। নাগরিকদের ভেতরকার শূন্যতা একসময় এক আত্মিক উপলব্ধির দিকে এগোয়—তারা বুঝতে পারে, এ শূন্যতাই প্রকৃত অর্থে গভীর রূপান্তরের আহ্বান। তারা হৃদয় খোলে, নীরবতার ভেতর শুনতে চায় জীবন-সুর।
দ্বিতীয় পর্বে নাগরিকরা পাখির রূপক ধারণ করে। তারা একত্র হয়ে এক বিধানসভা গঠন করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় পরম সত্যকে খুঁজে বের করার। হুদহুদ পাখি হয় তাদের পথপ্রদর্শক। এ পর্বে আত্মজিজ্ঞাসার প্রতীক হিসেবে পাখিদের প্রস্তুতির অনুশীলন, মানসিক বিতর্ক, ওড়ার সংকল্প ফুটে ওঠে।
তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বে পাখিদের যাত্রা শুরু হয়। পথজুড়ে তারা নানা প্রলোভন, ভয়, ক্লান্তি, সন্দেহ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে। কিছু পাখি ঝরে যায়, কেউ কেউ টিকে থাকে—যারা প্রেম, ত্যাগ, ধৈর্য, প্রজ্ঞা এবং জ্ঞান উপত্যকা অতিক্রম করে।
পঞ্চম তথা শেষ পর্বে তারা পৌঁছায় বাদশাহ সি মোরগের (সি মানে ত্রিশ, মোরগ মানে পাখি) দরবারে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে, সেই সি মোরগ আর কেউ নয়—তারা নিজেরাই। আত্মজ্ঞানই পরম সত্য। বাহ্যিক অনুসন্ধান নয়, আত্মার গভীর অন্বেষণই জীবনের প্রকৃত অর্থ।
বিভিন্ন পাখি এবং প্রতীকী চরিত্রে অভিনয় করেছেন তরুণ ও অভিজ্ঞ শিল্পীরা। হাস, হুদহুদ পাখি, তোতা পাখি, দাসী, প্রহরী, গুরু, রাজা, প্যাঁচা, শাহজাদি, জেলে বালক, গোরখোদক, বাদশাহ, কবুতরসহ একাধিক চরিত্র নাটকে জীবন্ত হয়ে উঠেছে আল মামুন, তাহিয়া তাসনিম, সৈকত, নিকিতা আযম, রিফাত, ফকির, করবী, মুক্ত, তানভীর, শাওন, প্রাণ কৃষ্ণ, জাদিদ, বাদলসহ অনেকের প্রাণবন্ত অভিনয়ে।
নাটকের মঞ্চ, পোশাক, দেহবিন্যাস, সংগীত, আলোক পরিকল্পনা ও ডিজিটাল দৃশ্যায়নে ছিল একদল নিবেদিতপ্রাণ সৃষ্টিশীল মানুষের নিবিড় শ্রম।
মন্তব্য করুন